১৯৯৫-এর শুরুর দিকে দুই স্ট্যানফোর্ড আন্ডারগ্রাজুয়েট শিক্ষার্থী ওয়েবপেইজের ইনডেক্স তৈরির নতুন পদ্ধতি নিয়ে কাজ শুরু করে। এটি ছিল আসলে ‘সার্চ ইঞ্জিন’। এতে তারা নিজস্ব অ্যালগোরিদম কৌশল প্রয়োগ করেছিল যা সব পেইজকে একটি ম্যাপে নিয়ে রাখে। সব ওয়েবপেইজ এই পদ্ধতির মাধ্যমে ইন ও আউট হয়। তারা সার্চ ইঞ্জিনের নাম দিল ‘ব্যাকরাব’।
১৯৯৬ সাল নাগাদ ব্যাকরাব এত বড় হয়ে গেল যে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির সার্ভারে সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। এ অবস্থায় এই শিক্ষার্থীর সামনে দু’টি পথ খোলা ছিল; এই অ্যালগরিদমকে বিক্রি করে দেয়া অথবা এটিকে ব্যবসায় রূপান্তর করা।
ইন্টারনেটের সৌভাগ্য যে তারা দ্বিতীয় অপশনটিকে বেছে নিল। তারা প্রথমেই ব্যাকরাব-এর নাম পরিবর্তন করা গুগল করলো। এরপরে কী হয়েছে নিশ্চয়ই তা আপনাকে ব্যাখ্যা করতে হবে না।
ব্র্যান্ড কিভাবে কাজ করে
একটি ভালো ব্র্যান্ড নেইম নির্বাচন করা শুধুই সপ্তাহ জুড়ে অনেক মাথা ঘামিয়ে নাম ঠিক করা নয়। এখানে বিষয় হচ্ছে, সৃজনশীলতার কার্যকারিতা পরীক্ষা করা, সম্ভাব্য ক্রেতাদের বিষয়ে নজর দেয়া, প্রতিযোগীদের বিশ্লেষণ করা এবং সবচেয়ে জরুরী হচ্ছে, এই ব্র্যান্ডটি কতটা মূল্য সংযোজন করতে পারবে তা বিশ্লেষণ করা।
একটি ব্র্যান্ড নেইম ঠিক করতে গিয়ে খ্যাতিমান পরামর্শক এজেন্সি ১০ লাখ ডলারের বেশি ফি নিয়ে থাকে।
আপনি নিজেই এমনটা করতে পারেন যদি ব্র্যান্ডের কলাকৌশল কিভাবে কাজ করে তা বুঝতে সক্ষম হন।
ব্র্যান্ডিংয়ের দুই স্তম্ভ
বিচ্ছিন্নভাবে কোন ব্র্যান্ড নেইমের অস্তিত্ব থাকে না। পোশাক রিটেইলিংয়ের জন্য যে পদ্ধতি গাড়ি প্রস্তুতকারীদের জন্য তা প্রযোজ্য হবে না। সেজন্য এটা বোঝা খুব জরুরি যে, ব্র্যান্ডের প্রকৃত মূল্য কিভাবে তৈরি হয়।
বাহ্যিক ও অন্তর্নিহিত গুণগত ধারণা
প্রত্যেকটি ব্র্যান্ড তার মূল্য সংযোজন করে থাকে বাহ্যিক এবং অন্তর্নিহিত গুণগত ধারনা থেকে। অন্তর্নিহিত ধারণা পণ্যের নিজস্ব যোগ্যতা। আর বাহ্যিক গুণগত ধারণা বাইরের বিভিন্ন ফ্যাক্টর থেকে অর্জন করা হয়।
অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক গুণগত ধারণা একটির সাথে আরেকটি নিবিড়ভাবে জড়িত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি ডিজাইনার জুতা প্রস্তুতকারক যে দামি উপকরণ ব্যবহার করে থাকে ক্রেতাদের বিশেষ অংশকে আকৃষ্ট করার জন্য। বিপরীতক্রমে, ব্যাপক হারে উৎপাদিত জুতা সস্তা উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়। উভয়ক্ষেত্রে অন্তর্নিহিত ফ্যাক্টর বাহ্যিক ফ্যাক্টরকে প্রভাবিত করে। পণ্যটির ব্র্যান্ড, কোন পযায়ে বিক্রি হয়, লেভেলের তথ্য, প্রভৃতিও বাহ্যিক ফ্যাক্টরকে প্রভাবিত করে।
বাহ্যিক গুণগত ধারণা পরিবর্তন হলে ক্রেতাদের বিবেচনায় অভ্যন্তরীণ গুণগত বিষয়ে নতুন ধারণা তৈরি হয়। ১৫৬৪ জন ক্রেতা নিয়ে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ব্র্যান্ড নেইমের খ্যাতি বদলে যায় যদি উন্নত উপকরণ দিয়ে পণ্যটি তৈরি করা হয়।
বুদ্ধিমান ক্রেতা এবং সাধারন ক্রেতা
আপনার পণ্য সম্পর্কে সব ক্রেতার যথেষ্ট জ্ঞান থাকবে না। ধরুন, আপনি একটি ল্যাপটপের দোকান পরিচালনা করেন। এখানে ৫০ বছর বয়সী এক খালাম্মা প্রথম ল্যাপটপ কিনতে আসলেন যে কম্পিউটার সম্পর্কে খুব কম জানে। এমন ক্রেতাকে আপনি সাধারন ক্রেতাদের একজন হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন। অপরদিকে ২১ বছর বয়সী কম্পিউটার সায়েন্সের একজন শিক্ষার্থী ল্যাপটপ সম্পর্কে প্রচুর জানে। তাকে ধরতে পারেন বুদ্ধিমান ক্রেতা হিসেবে। এই তরুণ নিশ্চিতভাবে অভ্যন্তরীণ গুণাবলীকে বিবেচনা করবে। বাহ্যিক বিষয় তেমন গুরুত্বপুর্ণ নয় তার কাছে।
একজন ক্রেতা কোনো একটি পণ্য সম্পর্কে কতটুকু জানেন তার উপর নির্ভর করে তার কেনাকাটা।
- পর্যাপ্ত জানা ক্রেতারা অন্তর্নিহিত গুণগত মান সম্পর্কে মনোযোগী হন।
- কম জানা ক্রেতারা মনোযোগী হন বাহ্যিক গুণগত মানের প্রতি।
নারীদের ব্লেজার বিষয়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্রেতা নিজের ক্ষেত্রে ফ্যাশন বিশেষজ্ঞ হিসেবে মনে করে অর্থাৎ পর্যাপ্ত জানে। সে অন্তর্নিহিত গুণগত মানের প্রতি মনোযোগী হয়। যেমন সেলাইয়ের গুণগত মান, উপকরণ প্রভৃতি। তারপরে সে কেনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়।
অপরদিকে, অল্প জানা ক্রেতারা নির্ভর করে বাহ্যিক গুণগত ধারণার উপরে। যেমন ব্র্যান্ডের নাম, মূল্য এবং পরিবেশনা। সব বিবেচনায় নিয়ে সে সিদ্ধান্ত নেয়।
ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠার পাঁচ সূত্র
ব্র্যান্ডের শক্তির বিষয়ে আপনার ধারণা রয়েছে নিশ্চয়ই। এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে কার্যকর ব্র্যান্ড নেইম নির্ধারণ করার কৌশল:
১. আপনার টার্গেট গ্রুপ অনুসারে ব্র্যান্ড নেইম পছন্দ করুন
উপরে আমরা বুঝতে পেরেছি, ক্রেতা কতটুকু জানে একটি পণ্য সম্পর্কে এবং তার মূল্য বুঝতে কী কী বিবেচনা করে।
যেসব ব্র্যান্ড অল্প জানা ক্রেতাদের কাজ করে তারা সাধারণত বিমূর্ত নাম বেছে নেয়। এমন নাম তার বেছে নেয় যা মনে ইতিবাচক ধারণা দেয় অথবা কার্যক্রমকে উৎসাহিত করে এবং ব্র্যান্ডের সাথে সংযুক্ত করে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নৌ-যাত্রায় উৎসাহ দেয়া পোশাক কম্পানি ‘নটিকা’। এই নাম তারা বেছে নিয়েছে ইটালিয়ান শব্দ নটিকা থেকে যার অর্থ নাবিক।
এই নামটি কার্যকরভাবে নৌ-যাত্রার সংকেত হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এটি অল্প জানা ক্রেতাগোষ্ঠীকে ব্র্যান্ডের সাথে যুক্ত করে ইতিবাচকভাবে।
বিপরীতভাবে, যে সমস্ত ব্র্যান্ড বেশি জানা ক্রেতাদেরকে আকৃষ্ট করতে চায় তারা ব্র্যান্ডের এমন নামের উপর নির্ভর করে না যা খুব উচ্চ ধারণা দেয়। সহজ একটি নাম ব্যবহার করে যেন ক্রেতারা এর অন্তর্নিহিত গুণের প্রতি মনোযোগী থাকতে পারে।
এর উদাহরণ হচ্ছে, টমফর্ড। একটি ডিজাইনার লেবেল। এটি প্রতিষ্ঠাতার নামের উপর ভিত্তি করে খ্যাতিমান হয়েছে।
২. যতটা সম্ভব সহজ রাখুন
ফোর্বসের তালিকায় সবচেয়ে বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর তালিকার দিকে খেয়াল করুন। সারা বিশ্বের শীর্ষ ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে প্রায় সবগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, খুব সহজ এবং উচ্চারণে সাবলীল। এসব নামে ১ থেকে ৪টি ভাওয়েল থাকে। দীর্ঘ নামের ক্ষেত্রে প্রথম অক্ষর ব্যবহার করা হয়। যেমন ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস মেশিনস (আইবিএম) অথবা জেনারেল ইলেকট্রিক (জিই)।
ব্যবসার জন্য আকর্ষণীয় একটি নাম কিভাবে চূড়ান্ত করবেন।
নিচের পরামর্শগুলো অনুসরণ করুন:
- প্রতিটি শব্দ জন্য ২ থেকে ৩টি ভাওয়েলে সীমিত থাকুন।
- জোরালো ভাওয়েল ব্যবহার করুন। যেমন O (উদাহরণ গুগল, টয়োটা ইত্যাদি)।
- নামটি সংক্ষিপ্ত করুন। সবচেয়ে ভালো হয় এক শব্দ বেশি হলে দুই শব্দ।
- উহ্য অক্ষর সীমিত রাখুন। যতটা সম্ভব ফনেটিক শব্দ ব্যবহার করুন। গবেষণায় দেখা গেছে এভাবে করলে ব্র্যান্ড অনুবাদের ক্ষেত্রে সহজতর হয়।
- অপ্রয়োজনীয় suffix-prefix (যেমন the) বাদ দিন।
৩. বর্ণনামূলক বিশেষণ ব্যবহার করুন যেন ক্রেতার আগ্রহকে প্রতিফলিত করে।
১৯৮৫ সালে ডায়েট ডিলাক্স নামে ফ্রোজেন ফুডস চালু করে কোনাগ্রা নামের কোম্পানি। এতে ডায়েটকে প্রাধান্য দেয়া হয়। এই নামটি বিশেষভাবে নির্বাচন করা হয়েছিল সেই ক্রেতাদের লক্ষ্য করে যারা আশি ও নব্বই দশকে ডায়েট সম্পর্কে সচেতন ছিলেন।
একবিংশ শতাব্দীর শুরু নাগাদ এই পণ্যগুলোর বিক্রয় কমতে থাকে। অভ্যন্তরীণ গবেষণায় জানা গেল, ডায়েটিংয়ের ধারণা বদলে যাচ্ছে। নিছক ডায়েট এর পরিবর্তে ক্রেতারা এখন চায় সুস্বাস্থের ভারসাম্য রক্ষা করে এমন খাদ্যপণ্য, নিছক স্লিম হবার জন্য নয়।
ব্যবসায়ের নামের বিষয় সিদ্ধান্তে আসার জন্য তিনটি সহজ ধাপ উল্লেখ করা হলো:
প্রথম ধাপ:
আপনার পণ্যের অন্তর্নিহিত গুণগত মানের ধারণাগুলোর তালিকা করুন। ধরুন আপনি বিস্কিট বিক্রির পরিকল্পনা করছেন। এই বিস্কিট সফট হতে পারে, রংয়ের মধ্যে চমৎকার বিন্যাস থাকতে পারে। এই বিষয়গুলো নামকরণের ক্ষেত্রে কাজে লাগবে।
দ্বিতীয় ধাপ:
আপনার ক্রেতাদের ব্যক্তিত্ব এবং পছন্দের দিকগুলো তালিকাভুক্ত করুন। আপনার বিস্কিট কোম্পানির ক্ষেত্রে তারা বাহ্যিক বিষয়গুলো যেমন মূল্য অথবা স্বাদ কেমন এবং উপাদানের মান সম্পর্কে আগ্রহী থাকতে পারে।
তৃতীয় ধাপ:
উপরের দুইটি তালিকাতেই খেয়াল করুন কমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটাকে আপনার ব্র্যান্ডের কাজে লাগান। যেমন আপনার ক্রেতারা ফ্রেশ তৈরি বিস্কিটকে গুরুত্ব দিচ্ছে এবং দামেও সাশ্রয়ী। সেক্ষেত্রে আপনার নাম করতে পারেন ফ্রেশবেক্স।
৪. আপনার টার্গেট কাস্টমারদের কাছে জানতে চান
এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, ক্রেতাদের পছন্দসমূহকে বিবেচনায় রাখতে হবে। হতে পারে প্রতিষ্ঠানের নামের বিষয়ে আপনি খুবই অনুভূতিশীল এবং আবেগপ্রবণ কিন্তু ক্রেতাদের ভাবনা তেমন নাও হতে পারে। এজন্য ক্রেতাদের চাহিদার বিষয়ে জরিপ করে নিতে পারেন।
৫. নিশ্চিত হন, ডোমেইন পাওয়া যাবে কিনা
সবশেষে বলতে হয়, নাম চূড়ান্ত করার আগে নিশ্চিত হন কাঙ্খিত নামে ডোমেইন নেম ডট কম দিয়ে পাওয়া যাবে কি-না। এখনকার বাস্তবতায় এটা গুরুত্বপূর্ণ।
উপরের বিষয়গুলো ভালোভাবে খেয়াল করলে আপনি খুব সহজে আপনার ব্যবসার জন্য সুন্দর ব্র্যান্ড নেইম নির্ধারন করতে পারবেন।